মো: আরিফুল ইসলাম : বাঁশ আর বেত। এই দুইয়ের মিশেলে নিপুণ হাতে বানিয়ে চলেছেন একেকটি মোড়া। এভাবেই গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে মোড়া তৈরি করে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছেন নারীরা। এসব নারীদের হাত ধরে শুধু পরিবার নয়, বদলে গেছে গোটা দুটি গ্রাম।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লী কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়া গ্রামের সংগ্রামী নারীরা তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রমে পরিবারে এনেছে স্বচ্ছলতা।
পিছিয়েপড়া এ জনপদের নারীদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠেছে ছোট ছোট কুটির শিল্প।
মাটিরাঙ্গার কাজীপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে বাড়ির উঠানে মোড়া তৈরি করছেন আয়েশা আক্তার। মায়ের সাথে বসে নিপুন হাতের ছোঁয়ায় বাঁশ-বেতের সমন্বয়ে মোড়া তৈরী করছে কলেজ পড়ুয়া আখি। শুধুমাত্র আখিই নয়, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এমন অনেকেই লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের সাথে মোড়া তৈরীর কাজ করে থাকে।
মোড়া বানানোর ফাঁকে ফাঁকে কথা হলে আয়শা বেগম জানান, দীর্ঘ ৭/৮ বছর ধরে মোড়া তৈরি করছেন। আগে একজনের আয়ে সংসার চলতো। আর এখন স্বামীর পাশাপাশি তিনিও আয় করছেন। সংসারের খরচের পর বাড়তি টাকা সঞ্চয় করছেন। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন।
একটু দূরেই পাশের বাড়িতে মোড়া তৈরি করছেন দুই জা আকলিমা বেগম ও আমেনা বেগম। তারা বলেন, এখানকার প্রতিটি বাড়িতেই মোড়া তৈরি করা হয়। পরিবারের কাজ শেষে সবাই মোড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। কারোরই যেন অবসর নেই। মোড়া তৈরি করে সকলের পরিবারেই কমবেশী আর্থিক স্বচ্ছলতা এসছে বলে জানালেন আকলিমা বেগম।
হাতিয়াপাড়ার জেসমিন আক্তার বলেন, আমরা নারী, আমরাও পারি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে নারীরাও পারে পরিবারের স্বচ্ছলতায় ভুমিকা রাখতে। আকার ও মান অনুযায়ী প্রতি জোড়া মোড়া বিক্রি হয় ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০ টাকায়। প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ জোড়া মোড়া তৈরি করে একেকজন নারী। যা থেকে একেকজন সপ্তাহে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আয় করে থাকেন।
এসব নারীদের নিপুন হাতে তৈরি এ-সব মোড়া ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীসহ সমতলের জেলাগুলোতে। স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে এসব মোড়া সমতলের জেলাগুলোতে বাজারজাত করার মতো কাজটি করে থাকেন স্থানীয় পাইকার মো: দেলোয়ার হোসেন। দেশের সমতলের বাজারে এখানকার মোড়ার ব্যাপক চাহিদার কথা জানিয়েছেন তিনি।
কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা বোঝা না হয়ে সংসারের হাল ধরেছেন মন্তব্য করে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো: আলাউদ্দিন লিটন বলেন, মোড়া তৈরিতে নিয়োজিত নারীরা যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে এটি পাহাড়ের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে।
গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন বলেন, নারীরাও পারে এটার অনন্য উদাহরণ গড়েছে কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা। তারা শুধুমাত্র পারিবারিক কাজে নিজেদের আটকে না রেখে অবসর সময়ে মোড়া তৈরী করে বাড়তি আয় করছে। দেশের অর্থনীতিতে ভুমিকা রাখা মোড়াকে শিল্প হিসেবে ঘোষনার দাবী জানান তিনি।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডেজী চক্রবর্তী বলেন, পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতায় ভূমিকা রাখা এসব নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তাদেরকে ঋণ প্রদানসহ মোড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। মোড়াকে বিশেষ শিল্প হিসেবে ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :