মো. সোহেল রানা : খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় তামাক চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ফসলি জমি, নদীর চর, বিদ্যালয়ের আশপাশ এমনকি বাড়ির আঙিনাতেও তামাক চাষ করা হচ্ছে। এই অঞ্চলের উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তামাক চাষে আকৃষ্ট করছে। ফলে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়েছে এবং পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
তামাক চাষের বিস্তার ও কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে কার্যকর প্রয়োগের অভাব রয়েছে। দীঘিনালায় বর্তমানে প্রায় ৪৭১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় ৪১ হেক্টর বেশি। মেরুং ইউনিয়নের তামাক চাষি মো. কামাল হোসেন বলেন, “তামাক চাষে কোম্পানি আমাদের অগ্রিম লোন দেয়, সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ করে এবং উৎপাদিত তামাক কিনে নেয়। তাই বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকায় আমরা তামাক চাষে আগ্রহী। অন্য ফসল চাষ করলে বাজারে ন্যায্য দামে বিক্রি করা কঠিন হয়, ফলে লোকসানের আশঙ্কা থাকে।”
পরিবেশ ও বনাঞ্চলের ভয়াবহ ক্ষতি
তামাক চাষের কারণে বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপজেলায় প্রায় ৭০০ তামাক চুল্লি রয়েছে, যেখানে প্রতিটি চুল্লিতে বছরে ৭-৮ শত টন লাকড়ি পোড়ানো হয়। এসব লাকড়ি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে। তামাক চুল্লির চিমনি দিয়ে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ও নিকোটিন পরিবেশকে দূষিত করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
তামাকের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি
দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. তনয় তালুকদার জানান, “তামাক চাষ শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য নয়, কৃষকদের স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হজম শক্তি কমে যাওয়া এবং নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তামাক চাষীদের এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।”
তামাকের বিকল্প ফসলের অভাব ও করণীয়
দীঘিনালা একসময় বিভিন্ন সবজি ও রবিশস্য উৎপাদনের জন্য পরিচিত ছিল, যা কৃষকদের লাভজনক ও স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ছিল। তবে তামাক চাষের প্রসারের ফলে এসব ফসল এখন কমে গেছে। দীঘিনালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জানান, “তামাক চাষ করতে মাটি গভীরভাবে চাষ করা হয়, যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। তবে কৃষকদের তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে এবং বিকল্প কৃষি ফসলের দিকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে।”
তামাক চাষ সাময়িকভাবে কিছু কৃষককে লাভবান করলেও সামগ্রিকভাবে এটি কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনের ফাঁদ থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প লাভজনক কৃষি ফসলের বাজার নিশ্চিত করা গেলে কৃষকরা ধীরে ধীরে তামাক চাষ থেকে সরে আসতে পারেন। তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন :