ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা ‘আদিবাসী


admin প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৭, ২০২৪, ৯:৫৭ অপরাহ্ন /
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা ‘আদিবাসী
 মো: আলম খান : এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, সহকারি এটর্নি জেনারেল ফর বাংলাদেশ :
‘আদিবাসী’ মানে হচ্ছে ‘আদিমতম অধিবাসী’ বা ‘ভূমিপুত্র’। ‘আদিবাসী’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Indigenous people’. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’ মর্গান বলেন, ‘The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial … they are the true Sons of the soil..’ .(Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972)
একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল ‘আদিবাসী’ বিতর্ক তুলে ইতিহাস বিকৃতায়নের মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে হেয় প্রতিপন্ন করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্যবহুল আলোচনা। নিচের তথ্যসূত্রগুলোর সাহায্যে আমরা যাচাই করে দেখবো, বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পাহাড়িদের এদেশের আদিবাসী বলা যাবে কি না। চলুন শুরু করা যাক।
(১)
ভারত-মিয়ানমার থেকে আসা ‘অভিবাসীরা’ কখনো আদিবাসী হতে পারে না। বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে উপজাতিদের বসতি স্থাপনের বহু পূর্ব থেকেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, যদিও সমতলের তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলে তাদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। প্রস্তর যুগের বাঙালি সভ্যতার নিদর্শন স্বরুপ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা রাঙ্গামাটিতে ‘Stone Element’ (পাথরের তৈরি অস্ত্র) ও ফেনীতে ‘Hand Axe’ (কুঠার) উদ্ধার করেছে, যেগুলোর বয়স ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ বছর।
বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়, তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ RHS Huchinson (1906), T H Lewin (1869), অমেরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬), J. Jaffa (1989) এবং N Ahmed (1959) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়।
(২)
চাকমা পণ্ডিত অমেরেন্দ্র লাল খিসা ‘অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগং’ এ লিখেছেন, ‘তারা এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে পরবর্তীতে আরাকান এলাকায় এবং মগ কর্তৃক তাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করেন। আজ থেকে আড়াইশ তিনশ; বছর পূর্বে তারা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর দিকে রাঙামাটি এলাকায়।’ এর প্রমাণ ১৯৬৬ সালে ‘বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’ প্রকাশিত ‘দি অরিয়েন্টাল জিওগ্রাফার জার্নাল’।
(৩)
চাকমারা আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ থেকে তিনশ’ বছর পূর্বে মোগল শাসনামলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মায়ানমার আরকান অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে (Lewin, 1869). প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ প্রশাসক টি. এইচ. লেউইন-এর মতে, ‘A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hill Tracts undoubtedly come about two generations ago from Aracan. This is asserted both by their own traditions and by records in Chittagong Collectorate’. (Lewin, 1869, p. 28). অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী বিষয়ে ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসিডিএম) ক্যাপ্টেন টমাস হার্বার্ট লেউইনের মতে, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর বেশির ভাগই নিশ্চিতভাবে দুই পুরুষ আগে আরাকান (অর্থাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে) থেকে এসেছে।’ আসলে ১৮২৪ সালে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) যুদ্ধে শরণার্থী হিসেবে এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এখানে এসেছিল।
(৪)
‘পার্বত্য চট্টগামে ১২টা ভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাস করে। এদের বেশির ভাগই ১৬ থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় এই অঞ্চলের বাইরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে আগে আসে চাকমা সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি অঞ্চল অতিক্রম করে এসে ১৭ শতকের মধ্যেই তারা চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে শুরু করে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বাস করতে থাকে। সে সময় স্থানীয় বাঙলাভাষীদের সাথে জমি নিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের নিরন্তর ঝামেলা লেগেই থাকতো।’ (Genocide in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh; IWGIA Document 51, Wolfgang May (ed.), Page: 14-15).
(৫)
১৯৬৯ সালে রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ বইয়ে (দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৫), পাহাড়ের অধিবাসীদের ‘উপজাতি’ অভিধাতেই ভূষিত করা হয়েছে।
‘উপজাতিরা সংস্কারপ্রিয়। ইহাতে অতীতে চাকমারা প্রতিবেশী হিন্দু ও মুসলমানদের সংস্পর্শে আসিয়া বহু ধর্মীয় সংস্কার অনুকরণ করে ঠিকই। আর ইহারই কারণ J.H. Hutton ও সুবোধ ঘোষ মহাশয় উভয়েরই মন্তব্যে প্রকাশ উপজাতীয় সংস্কারাদি হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক করা দুস্কর।’ (দেওয়ান ব.ম., চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, ২০০৫, পৃ. ২১৩)।
(৬)
বাংলা ১৩৯২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সিদ্ধার্থ চাকমার ‘প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বইয়ে পাহাড়িদের ‘উপজাতি’ হিসেবেই অভিহিত করা হয়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, উপজাতি সম্পর্কিত সব দায়দায়িত্ব সরকার ছেড়ে দিয়েছে আমলাদের হাতে। তাদের মতে, রাজনৈতিক কমিটি যদি গঠিত হতো তাহলে আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জটিল হতে হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সমস্যা বর্তমানের সংকটরূপ ধারণ করত না।’ (চাকমা স., ১৩৯২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৩৪)।
(৭)
১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির রাঙামাটি আগমন উপলক্ষে স্থানীয় পাহাড়ি নেতারা জিয়াউর রহমানকে যে স্মারকলিপি প্রদান করেন, সেখানে পাহাড়ের অধিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, উক্ত স্মারকলিপি প্রদানকারীদের মধ্যে চারু বিকাশ চাকমা, অশোক কুমার দেওয়ান, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, মং শৈ প্রু চৌধুরী (বোমাং সার্কেল চিফ), মং প্রু সাইন (মং সার্কেল চিফ) এবং বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা, সাবেক এমপিএ উল্লেখযোগ্য। (রহমান, পার্বত্য তথ্য কোষ, ২০০৭, পৃষ্ঠা. [১২৯-১৩৫](tel:129135)), (রহমান, পার্বত্য তথ্য কোষ, ২০০৭, পৃষ্ঠা [১২৯-১৩৫](tel:129135))।
(৮)
১৯৯৩ সালের জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা রচিত ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’ বইয়েও ‘উপজাতি’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তিকে অপব্যাখ্যা করে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) উপজাতীয় জনগণের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়। উপজাতীয়রা বাঙালি বলতে বাঙালি মুসলমানদের বোঝে। জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) শেখ মুজিবের উপরোক্ত বক্তব্যকে অপব্যাখ্যা করে বলেছে, ‘তিনি উপজাতীয় জনগণকে বাঙালি আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে উপজাতীয়দের সবাইকে বাঙালি বা মুসলমান হতে হবে। সবাইকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে।’ (চাকমা জ. ব., ১৯৯৩, পৃষ্ঠা. ৫২)।
(৯)
মারমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে মিয়ানমার (বার্মা) থেকে। মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং আধিপত্য বিস্তার করে। (Shelley, 1992 and Lewin, 1869).
বান্দরবনের সাবেক মং রাজা অংশে প্রু চৌধুরী এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা এই অঞ্চলে আদিবাসী নই’। বান্দরবান এলাকায় মারমা বসতি ২০০ বছরেরও পুরোনো। মং রাজাদের বংশলতিকা এবং ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকায় এ বিষয়ে সংশয়ের কিছু নেই।
(১০)
চাকমারা যে ভাষায় কথা বলেন, বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ার্সনের মতে সেটা হলো চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাংলা উপভাষারই একটি রূপ মাত্র। মারমাদের ভাষা চাকমাদের ভাষা থেকে আলাদা। তারা যে ভাষায় কথা বলেন, তা হলো আরাকানি ভাষার একটি রূপ। আরাকানি ভাষা আবার প্রাচীন বর্মি ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
(১১)
ত্রিপুরারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। সেখানকার রাজরোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
(১২)
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এসব জনগোষ্ঠীগুলোর প্রায় সবাই যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং হিংস্র দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে তাদের পুরাতন বসতি স্থান থেকে এখানে পালিয়ে এসেছ। নতুবা, এক জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণকারী হিসেব এদেশে প্রবেশ করেছে।’ (Hutchinson, 1909, Bernot, 1960 and Risley, 1991).
(১৩)
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মণিপুরী ও পাত্ররা তৎকালীন বৃহত্তর আসামের খাসিয়া জয়ন্তী পাহাড়, মণিপুর, কাঁচাড় ও অন্যান্য সংলগ্ন দুর্গম বনাচ্ছাদিত আরণ্যক জনপদ থেকে যুদ্ধ, আগ্রাসন, মহামারী এবং জীবিকার অন্বেষণে সুরমা অববাহিকায় প্রবেশ করে ও সিলেটের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে বসতি স্থাপন করে। নৃ-বিজ্ঞান ও ভৌগোলিক জ্ঞানের সকল বিশ্লেষণেই এরা উপজাতীয় এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বৈ আর কিছুই নয়। এরা কোনো বিবেচনায়ই সিলেটের আদিবাসী হতে পারে না। এরা আদি আরণ্যক পার্বত্য নিবাসের (আসাম, মণিপুর, মেঘালয় ইত্যাদি) আদিবাসী হলেও যখন স্থানান্তরিত হয়ে নতুন ভূখণ্ডে আসে সেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠী কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে সমান্তরালভাবে থাকতে পারে। কিন্তু কখনো তারা নতুন জায়গায় আদিবাসী হতে পারে না। ঠিক একইভাবে, ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট অঞ্চল) এবং টাঙ্গাইল অঞ্চলের (মধুপুর) গারো, সিংট্যানেরা ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের পরে এদের অনেকে তাদের আদিনিবাস ভারতের উত্তরের গারো পাহাড়ে ফিরে গেলেও বেশ কিছুসংখ্যক গারো ও সিংট্যানরা বাংলাদেশের ঐসব অঞ্চলে রয়ে গেছে। গারোদের আদি নিবাস ভারতের গারোল্যান্ড। কোনোক্রমেই তারা ময়মনসিংহ কিংবা টাঙ্গাইলের আদিবাসী হতে পারে না। আরো বলা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে আজ থেকে মাত্র ৬০-৭০ কিংবা একশ’, সোয়াশ’ বছর আগে সিলেটের শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং উত্তর সিলেটের কোনো কোনো নিচু পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগান স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা বর্তমান ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন জঙ্গলাকীর্ণ মালভূমি অঞ্চল যেমনঃ ছোট নাগপুরের বীরভূম, সীঙভূম, মানভূম, বাকুড়া, দুমকা, বর্ধমান প্রভৃতি অঞ্চল যা তৎকালীন সাঁওতাল পরগণাখ্যাত ছিল সেসব অঞ্চলে গরিব অরণ্যচারী আদিবাসী সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুল, বীর, অঁরাও, বাউরী ইত্যাদি নানা নামের কৃষ্ণকায় আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষকে শ্রমিক হিসেব স্থানান্তরিত করে অভিবাসী হিসেবে নিয়ে আসে।
(১৪)
একইভাবে যুদ্ধ, মহামারী থেকে আত্মরক্ষার জন্য এবং জীবিকার সন্ধানে রাজমহলের গিরিপথ ডিঙ্গিয়ে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলে (রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর) বাসবাস শুরু করে। উত্তরাঞ্চলের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা থেকে দক্ষিণের রংপুর-দিনাজপুরের নদী অববাহিকামণ্ডিত সমভূমিতে নেমে বসবাস শুরু করে কুচ ও রাজবংশী জনগোষ্ঠী। এরা সকলেই তাদের মূল নিবাসের আদিবাসী হিসেব বিবেচ্য হলেও কোনো যুক্তিতে তাদের নতুন আবাসস্থল বাংলাদেশের ঐসব অঞ্চলগুলোর আদিবাসী বা ভূমিপত্র হিসেব চিহ্নিত হতে পারে না।
অর্থাৎ এখানে বিবেচনা করতে হবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশের বর্তমান ভূখন্ড অধিকৃত হওয়ার পূর্ব থেকে বা প্রি-কলোনিয়াল কি-না। তবে এ আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় নির্ধারণ করা জরুরি যে, বিবেচনাটি কি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ভূখন্ডের উপর হবে, না বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক হবে। কারণ, অঞ্চলভিত্তিক হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যিনি প্রথম বসতিস্থাপন করেছেন তিনিও বাংলাদেশের আদিবাসী। এবং আগামীতে যদি বাংলাদেশ ভূখন্ডে নতুন কোনো দ্বীপ সৃষ্টি হয় আর সেই দ্বীপে যারা বা যিনি নতুন বসতি গড়বেন তিনিও আদিবাসী হবেন। বর্তমান সরকার নতুন সৃষ্ট ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে, সেটা যদি সফল হয় তাহলে রোহিঙ্গাদেরও কি বাংলাদেশের আদিবাসী বলা হবে? একইভাবে ঢাকার আদি বাসিন্দা যারা তারাও বাংলাদেশের আদিবাসী এবং যে সকল উপজাতি ঢাকায় নানাভাবে স্যাটেল করেছেন তারা স্যাটেলার? আর যদি সমগ্র বাংলাদেশ ভূখন্ড ধরা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্যজাতি। আর্যরা উত্তরবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। তখন বাংলাদেশ ভূখন্ডে চাকমা, মারমা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারো অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ আর্যদের আগমণের পূর্বে এখানে যে অনার্য জনগোষ্ঠী বসবাস করতো তারা প্রি-কলোনিয়াল। আর্যদের আগমনের পূর্বে এখানকার অনার্য বাসিন্দারা প্রাকৃত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। আর্যদের প্রভাবে তারা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে হিন্দু রাজাদের নিকট থেকে বাংলা বৌদ্ধ রাজাদের দখলে যায়। বাংলাদেশে বৌদ্ধদের ইতিহাস সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের আদি কিতাব চর্যাপদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলায় বৌদ্ধদের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস এক নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রি-কলোনিয়াল জনগোষ্ঠী হচ্ছে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এখানকার মূল জনস্রোত, বাঙালি জনগোষ্ঠী। সুতরাং বাংলাদেশের মূল ভূমিপুত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীই হলো এদেশের প্রকৃত আদিবাসী।
সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই বহির্বিশ্ব বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই অনুপ্রবেশও স্মরণাতীত কাল পূর্বে ঘটে নি। মাত্র কয়েকশ’ বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র বলার কোনো সুযোগ নেই।