ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া বনাম নিউ মিডিয়া: স্মার্ট মিডিয়ার প্রযোজ্যতা


admin প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২১, ২০২৫, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন /
ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া বনাম নিউ মিডিয়া: স্মার্ট মিডিয়ার প্রযোজ্যতা

 

মোঃ বেলায়েত হোসেন : তথ্য অফিসার, খাগড়াছড়ি :- ইংরেজি ‘Media’ পারিভাষিক শব্দটি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে কোন বার্তা পৌঁছানোর বা যোগাযোগের সকল মাধ্যম। প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপসর্গ বা বার্তার মাধ্যমে জীব প্রকৃতি, আবহাওয়া, জীববৈচিত্র্য কিংবা ভবিষ্যৎ জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যদিও বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও দ্রুত এ সম্পর্কে জানা যায়। অন্যদিকে, পার্থিব জগতে ঘটে যাওয়া কিংবা অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলী সম্পর্কে মানুষকে জানানো কিংবা যোগাযোগের মাধ্যমই আমাদের কাছে মিডিয়া বলে পরিচিত। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ১৯২০ সালের দিকে মিডিয়া শব্দের ব্যবহার হলেও অগোচরে থাকা পঞ্চদশ শতাব্দীতে হস্তলিখিত প্রেস, মধ্যযুগে আবির্ভূত দেওয়াল চিত্রও মিডিয়ার অনুষঙ্গ। জনসাধারনের মধ্যে তথ্য, জ্ঞান, মূল্যবোধের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম মিডিয়া ব্যতিত অন্য কিছু নয়। আর এ যোগাযোগে গণমানুষ অবিচ্ছেদ্য বলে এর নাম গণমাধ্যম হিসেবে অভিপ্রয়াস ঘটে। উপযোগিতা, বিতরণ ও প্রকাশের ধরণ এবং গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে বর্তমানে গণমাধ্যমকে ট্রেডিশনাল মিডিয়া (Traditional Media) বা প্রথাগত বা প্রচলিত গণমাধ্যম এবং নিউ মিডিয়া (New Media) বা নতুন গণমাধ্যম এ দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথাগত মিডিয়ায় যোগাযোগের ধরণ হচ্ছে স্থির এবং একমুখী। কর্তৃপক্ষ যা বলছেন পাঠক তা পড়ছেন বা গ্রহন করছেন। এক্ষেত্রে সাথে সাথে পাঠকের প্রতিক্রিয়া প্রেরণের সুযোগ নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে বিজ্ঞাপনদাতা যা কিছু সরবরাহ করছেন গ্রাহক তা গ্রহনে বাধ্য। নিউ মিডিয়ায় ঠিক তার উল্টোটা ঘটে। দ্বিমুখী যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় যা কিছুই প্রকাশ করা হোক না কেন সাথে সাথেই গ্রাহক বা পাঠকের কাছে সে বার্তা পৌঁছায় এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যায়।  পুরাতন ও নতুন এর সমন্বয়ে গণমাধ্যমকে বই, সংবাদপত্র, সাময়িকী, ধারণযন্ত্র, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ইন্টারনেট এ কয়েকটি ধরনে ভাগ করা হয়েছে। বই, সংবাদপত্র, সাময়িকী, ধারণযন্ত্র, রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রকে প্রথাগত মিডিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ইন্টারনেটের অত্যধিক প্রভাব বিস্তারের কারণে। অন্যদিকে, নিউ মিডিয়া বলতে ইন্টারনেট ভিত্তিক মিডিয়া যেমন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম –  ব্লগ, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার, ইন্সট্রাগ্রাম, লিংকেডিন, উইকি। ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবপোর্টাল, নিউজ পর্টালও নিউ মিডিয়ার অন্তর্ভুক্ত। নিউ মিডিয়া অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে সমগ্র ওয়ার্ল্ডকে ভার্চুয়ালি Global Village এ পরিণত করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সমাজের বিভিন্ন উপাদান, বৈশিষ্ট্য, সঙ্গতি-অসঙ্গতি এবং পরিবর্তন আমাদের সামনে খুব দ্রুত ভেসে আসে বলে এর ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াও খুব দ্রুত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে চতুর্থ স্তম্ভে থাকা, সমাজের দর্পণ বা আয়নার ন্যায় কাজ করা মিডিয়া সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। সঙ্গতি- অসঙ্গতি আয়নার ন্যায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করে। সেই দর্পণ ঘোলাটে হলে কিংবা ময়লা, ধুলোবালিতে আচ্ছন্ন হলে যেমনি মানুষ তাঁর নিজের ছবি পরিষ্কার দেখতে পায় না; ঠিক তেমনি মিডিয়ার অস্বচ্ছতা, হলুদ সাংবাদিকতা, পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সমাজ এবং রাষ্ট্র অনিশ্চিত গোলক ধাঁধায় ঘুরতে থাকে। বর্তমান সময়ে নিউ মিডিয়ার জনপ্রিয়তা, ব্যাপকতা- বিস্তৃতির কারণে অন্যান্য মিডিয়াকে সেকেলে বা ট্র্যাডিশনাল বলে মনে হয়। তবে ট্রেডিশনাল মিডিয়া বড় একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে গুজব তুলনামূলকভাবে কম ছড়ায় এবং প্রিন্ট ভার্সন প্রমাণক হিসেবে কিংবা তথ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নিউ মিডিয়া মাধ্যমে যে সংবাদটি সাথে সাথে জানা যায়, সংবাদপত্রের মাধ্যমে সেটি পরের দিন পাওয়া যায়। নিউজটির ভ্যালু অনেকাংশে কমে যায়। তবে সুবিধার পাশাপাশি নিউ মিডিয়ার বড় ধরনের অসুবিধার পর্বও রয়েছে। ভাইরাল বা ট্রল শব্দগুচ্ছ নিউ মিডিয়ায় ব্যাপক পরিচিত।  সাধারণত নিউ মিডিয়া বা সোস্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ এখনও বিশ্বের সকল ভাষায় কিংবা একটি দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত নিউজ বা কন্টেন্টকে ফিল্টার করতে অক্ষম। এতে ইতিবাচকতার পাশাপাশি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থে চরিতার্থ করার জন্য নেতিবাচকতার বিষবাষ্প-গুজবরূপে রটিয়ে- ঘটিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রূপে প্রসব ঘটায়। অসাধিত ক্ষতির সাধন ঘটে নিমিষেই। এ ছাড়া নিউ মিডিয়ার হাতিয়ার ইন্টারনেট ভিত্তিক হওয়ার হ্যাকিং সম্ভাবনা, ডাটা মুছে যাওয়া, আর্কাইভ লিমিটেশন ইত্যাদি নিউ মিডিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের সময়োপযোগি করে গড়ে তুলতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(AI) কে কাজে লাগানোর মিশন হাতে নেওয়া সময় সাপেক্ষ।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিশনাল মিডিয়া অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের হিসেব অনুসারে মে, ২০২৪ পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩২৭০টি। ১৩ জুন ২০২৪ পর্যন্ত মিডিয়া তালিকাভুক্ত মোট পত্রিকার সংখ্যা ৭০৮ যেখানে অষ্টম ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়নকারী পত্রিকার সংখ্যা ১৮৫ টি। ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নকারী পত্রিকার সংখ্যা মোট নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যার শতকরা ৫.৬৬ ভাগ। এই সংখ্যাই কি বাস্তবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদপত্র এবং সাংবাদিকের সংখ্যা নির্দেশ করে? সে প্রশ্ন এবং উত্তরের উৎকৃষ্ট নমুনা বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি। অন্যদিকে, নিউ মিডিয়া(একাংশ) সংক্রান্ত মাধ্যমগুলোর নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ তথ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, নিবন্ধিত আইপি টিভির সংখ্যা ১৪টি, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ২০৪টি, দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল(আঞ্চলিক) ৫৪টি, দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল ১১৪টি এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন পোর্টাল ১৬টি। কয়েক হাজার অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে সরব হয়ে ওঠে। মূলত, এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার সূত্র খুঁজতে ডান-বাম তাকাতে হচ্ছে। ট্রেডিশনাল মিডিয়া(মেইন স্ট্রিম অংশ) এবং নিউ মিডিয়ার একটি মিথস্ক্রিয়া ও সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল ধারার মিডিয়া স্ট্রিম গড়ে তোলার দিকে তাকিয়ে আছে বস্তুনিষ্ঠ স্মার্ট সাংবাদিকতা। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে ট্রেডিশনাল মিডিয়ার মেইন স্ট্রিম কিছু পত্রিকা এবং  টেলিভিশনের ডিজিটাল ভার্সন খুবই জনপ্রিয়। কর্তৃপক্ষ যদি প্রতিটি নিউজ সময়ের চাহিদা অনুসারে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে ভিডিও সহকারে ডিজিটাল ভার্সনে সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেয়, তাহলে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ডোমেইন ভাড়া নিয়ে প্রচারিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।  মানুষ মূলত মূল ধারার নিউজ পোর্টাল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের অভাবে নামসর্বস্ব মাধ্যমের নিউজ গ্রহন করে। অন্যদিকে, পাঠক বা গ্রাহকের স্মার্ট লিটারেচি (Smart Literacy) অত্যন্ত জরুরি। নির্ভরশীল মিডিয়াগুলোর নিউজের প্রতি অধিক আস্থাশীল হওয়ার বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। কোন নিউজটি সঠিক আর কোনটি ভুয়া, বিকৃত, অসত্য, বানোয়াট, গুজব সেটি বোঝার ক্ষমতা তৈরীতে স্মার্ট লিটারেচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের  অধীন গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের ৬৮টি তথ্য অফিসের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে স্মার্ট লিটারেচি (Smart Literacy) বিষয়ে অবহিত ও গুজব প্রতিরোধে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া তথ্য অধিদপ্তর কর্তৃক তৈরিকৃত “ফ্যাক্ট চেক মিডিয়া সেল” এর সঠিক তথ্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। স্মার্ট মিডিয়া(Smart Media) বলতে এমন এক ধরনের মিডিয়া যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য ট্রেডিশনাল মিডিয়াকে ডিজিটাল ভার্সন কিংবা নিউ মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যা খুব সহজে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় হওয়া সম্ভব। জাতি দ্বিধা -বিভক্ত হবে না। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ঐক্যমত্য গঠনে সহায়ক হবে। নাগরিককে স্মার্ট জ্ঞানসম্পন্ন জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা রাখবে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কান্ডারীদের আরও বেশি সচেতন, দক্ষ করে গড়ে তুলতে ট্রেডিশনাল এবং নিউ মিডিয়ার সমন্বয়ে তৈরি আস্থাশীল ও দায়িত্বশীল স্মার্ট গণমাধ্যমের স্থান অন্য কোনভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।