একটা সময় ‘আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব’ ছিল আরব আর ইসরায়েলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। অনেক বছর ধরে এটিকে নতুন নামে ব্র্যান্ড করা হচ্ছে। মিডিয়া এখন আমাদের বলছে, এটা ‘হামাস-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব’।
কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ কী? সহজ কথায় বললে, ইসরায়েল অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
আরবদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে তথাকথিত বিস্ময়কর বিজয় ইসরায়েলকে এতটাই উত্সাহিত করে যে সে নিজেকে আঞ্চলিক পরাশক্তি নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। ইসরায়েলের নিজের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে, সে ‘অজেয়’ হয়ে উঠেছে।
ফিলিস্তিনি ও আরবদের চেতনাকে একইভাবে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে এ ধরনের পরিভাষা নিছক কৌশলই ছিল না, ইসরায়েল এটা বিশ্বাসও করে বসেছিল।
১৯৬৭ সালে আরব সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘ইসরায়েলের অলৌকিক বিজয়’–এর মুহূর্ত ছিল একটি সন্ধিক্ষণ। এরপর জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত আববা ইবান ঘোষণা করেছিলেন, ‘জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে আমি আইডিএফের (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস) গৌরবময় বিজয় ও জেরুজালেমের মুক্তি ঘোষণা করেছি।’
ইবানের এই বক্তব্যে যে জিনিস বোঝাতে চাওয়া হয়, সেটি হলো, ‘ইসরায়েল এর আগে কখনো এতটা সম্মানিত বোধ করেনি এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে এতটা সম্মানিত হয়নি।’
ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতের এ কথা ইসরায়েলজুড়েই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এমনকি যাঁরা আরবদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ জয়ী হওয়ার ব্যাপারে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁরাও কোরাসে যোগ দিয়েছিল: ইসরায়েল অদম্য।
ইসরায়েল কেন জিতেছিল, তা নিয়ে তখন যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল সামান্যই। ওয়াশিংটনের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন এবং পশ্চিমাদের যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা ছাড়া যদি সম্ভব হতো, তা হলে তা ছিল ভিন্ন কথা।
ইসরায়েলের বিজয় মোটেও নিষ্কণ্টক ছিল না। বিজয়ী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের আয়তন তিন গুণ বৃদ্ধি পায়; ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশের ওপর ইসরায়েল তার সামরিক দখলদারিত্ব শুরু করে। এমনকি তারা নতুন অধিকৃত আরব অঞ্চলে—সিনাই, গোলান হাইটসসহ বাকি সব জায়গায় বসতি স্থাপন শুরু করে।
হঠাৎ আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল যে বিরাট সাফল্য পেয়েছিল, তা উল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ৫০ বছর আগে, ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব সেনারা তৎপর হয়েছিলেন। তাঁরা প্রাথমিকভাবে সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁদের ব্যর্থ হতে হয়, কেননা যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সর্বাত্মক সহায়তা শুরু করে।
এটি আরবদের জন্য সম্পূর্ণ বিজয় ছিল না, ইসরায়েলের জন্যও সম্পূর্ণ পরাজয় ছিল না। যদিও পরের পরিস্থিতি ছিল মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু তেল আবিব এই বিশ্বাসে অটল ছিল যে ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যে প্রাথমিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, সেটা অটুট রাখতে হবে।
এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘সংঘাত’ হতে থাকে কম মাত্রায় আরব-ইসরায়েলি, বিপরীতে আরও বেশি করে আবির্ভূত হতে থাকে ‘ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব’ রূপে। আরব ফ্রন্টের বিভাজনের জন্য লেবাননের মতো অন্যান্য আরব দেশকেও চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
এই পরিবর্তিত বাস্তবতার জন্য ইসরায়েল ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ করতে পারে এবং এর ছয় মাস পর মিসরের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে।
আরও বেশি ভূমির জন্য অতৃপ্ত ক্ষুধা নিয়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারত্ব যখন আরও সহিংস হয়ে ওঠে, তখন পশ্চিমারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাসংগ্রামকে তুলে ধরতে শুরু করে ‘সংঘাত’ হিসেবে। কথায় কথায় এটি বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে, যদিও দালিলিকভাবে তা হয়নি।
ফিলিস্তিনের অনেক বুদ্ধিজীবী যুক্তি তুলে ধরে বলতে থাকেন, ‘এটা কোনো সংঘাত নয়’। তাঁদের ভাষ্য ছিল, সামরিক দখলদারি কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নয়। সুতরাং এর সমাধান হতে হবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেই।
তবে এখনো তেমনটা ঘটেনি। অগণিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন, রেজল্যুশন, বিবৃতি, তদন্ত, সুপারিশ ও বিশেষ প্রতিবেদন সত্ত্বেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা ফিলিস্তিনের এক ইঞ্চি ভূমিও পুনরুদ্ধার করা হয়নি। বাস্তবোচিত প্রয়োগ ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন নিছক কালিতে লেখা অক্ষর ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু আরব জনগণ কি ফিলিস্তিনকে ত্যাগ করেছে? ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গাজা ধ্বংসের প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে রাজপথে নেমে আসা অবিরাম স্রোতের মতো মানুষ, তাঁদের ক্ষোভ, যন্ত্রণার প্রকাশ ও আবেগঘন স্লোগান দেখে মনে হয় না যে ফিলিস্তিন একা অথবা মনে হয় না যে অন্তত নিজেদের লড়াইটা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট থেকে ফিলিস্তিনকে বিচ্ছিন্ন করা বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে।
‘সংঘাত’ যখন শুধু ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে, তখন ইসরায়েল তথাকথিত সংঘাতের প্রেক্ষাপট ও সুযোগ নির্ধারণ করে নিজেদের মতো; ‘আলোচনার টেবিলে’ কী থাকবে আর কী থাকবে না, তা তারাই ঠিক করে। এভাবেই অসলো চুক্তি ফিলিস্তিনিদের অধিকার নষ্ট করেছে।
ফিলিস্তিনিদের যত বেশি তাদের অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সফল হবে ইসরায়েল, তত বেশি বিভাজনের পেছনে বিনিয়োগ করবে তারা।
হামাস ও ইসরায়েল যখন সংঘাতে জড়িত, তখন তা আরও বেশি বিপজ্জনক মাত্রা পেতে পারে। এখন যা জানানো হচ্ছে, তার বয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ইসরায়েলের বয়ান বলছে, যুদ্ধটা শুরু হয়েছে ৭ অক্টোবর, যখন হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণে তাদের সামরিক ঘাঁটি, বসতি ও শহরগুলোয় আক্রমণ করেন।
হামাসের হামলার আগে অন্য কোনো তারিখ বা ঘটনা ইসরায়েল, পশ্চিম ও করপোরেট মিডিয়ার কাছে কোনো বিষয় নয়, যত উদ্বেগ তাদের ইসরায়েলিদের দুর্দশার জন্য এবং গাজার নারকীয় অবস্থার ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। সেসব মিডিয়ায় জায়গাও পায় না।
ইসরায়েল ও এর জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসআইএসের মতো ফিলিস্তিনিরা অপতৎপরতা চালাচ্ছে—ইসরায়েলের এমন নিখুঁত আখ্যানের বিপরীতে অন্য কোনো ভাষ্যের যেন কোনো স্থানই নেই পশ্চিমে।
ফিলিস্তিনিরা যা উচ্চকণ্ঠে বলছেন, তা হলো, সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গাজা যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হোক—১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে জাতিগত নির্মূল অভিযান, ১৯৬৭ সালে জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা দখল, ২০০৭ সালে গাজা অবরোধ; সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আগে ও পরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হোক। কিন্তু এসবই অস্বীকৃতির নিচে চাপা পড়ে থাকে।
ইসরায়েলপন্থী মিডিয়া এসব শুনতে চায় না। এমনকি যদি ইসরায়েল শিরশ্ছেদ করা শিশুদের সম্পর্কে ভিত্তিহীন দাবিও করে বসে, তবু মিডিয়া ইসরায়েলিদের তেমন বর্ণনা প্রচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
ইসরায়েল যেভাবে তাদের মতো করে যুদ্ধের বর্ণনা, ‘সংঘাতের’ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক আলাপচারিতা জারি রাখে, পশ্চিমাদের চোখে ফিলিস্তিনিদের অবস্থান তেমনই আদল পায়। ফলে ফিলিস্তিনে সামরিক দখলদারিত্ব চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতার দ্বারও হাট করে খোলা থাকে।
ফলে আরও সংঘাত, আরও যুদ্ধ, আরও প্রতারণার ঘটনা ঘটতে থাকে।
এই দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য ফিলিস্তিনকে আরও একবার ইস্যুতে পরিণত হতে হবে, যা সব আরবসহ সমগ্র আরব অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের বিষয় বটে। ইসরায়েলি বয়ানকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে, পশ্চিমা পক্ষপাতের সমুচিত জবাব দিতে হবে। এ জন্য একটি নতুন সম্মিলিত কৌশল দাঁড় করাতে হবে।
অন্য কথায়, ফিলিস্তিনকে আর একা রাখা যাবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: হাসান ইমাম
(প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত)
আপনার মতামত লিখুন :