গত আট দিনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে এ পর্যন্ত দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছে কয়েক লাখ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ নারী ও শিশু। চার লাখের মতো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। খাবার, পানি ও জ্বালানির অভাবে মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বোমার আঘাতে বসতবাড়ি, দোকানপাট, হাসপাতাল ও স্কুল মাটির সাথে গুঁড়িয়ে গেছে। তবু ৫৭টি মুসলিম দেশে কার্যত তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। ২৩ লাখ জন-অধ্যুষিত ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের গাজা উপত্যকা এখন যমপুরী। গাজা মূলত পাখির খাঁচা। দু’দিকে ইসরাইল, এক দিকে ভূমধ্যসাগর। অন্যদিকে মিসর দিয়ে অবরুদ্ধ। বিশ্বের দু’টি শক্তিধর দেশ- যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরাইল বেপরোয়াভাবে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানোর সাহস পাচ্ছে, এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
গাজার ওপর ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞার ফলে আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিলিস্তিন। অথচ দেশটির অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভর করত এ স্থানটির ওপর। কৃষি ও শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের অভাবও ছিল লক্ষণীয়। এতে অবকাঠামোর দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। গাজা ও পশ্চিমতীর থেকে রাসায়নিক উপকরণ এবং সার আমদানির ক্ষেত্রেও বাধা দেয়ার পাশাপাশি ইসরাইল বলেছে, এসব উপাদান দিয়ে ফিলিস্তিনিরা অস্ত্র তৈরি করতে পারে। অথচ এর ফলে দেশটির শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। মৃতসাগরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর খনিজ, লবণ, পর্যটন ক্ষেত্রেও আয় থেকে বঞ্চিত ফিলিস্তিনিরা। অথচ মৃতসাগর ব্যবহার করে ইসরাইলি ঠিকই নিজেদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছে। ইসারাইলি কোম্পানিগুলো ডেড-সি সৌন্দর্যবর্ধক ও ত্বক সুরক্ষা পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করে প্রতি বছর আয় করছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। পশ্চিমতীরের খনি খনন ও পাথর উত্তোলন করেও সমৃদ্ধ হয়েছে ইসরাইলি বাণিজ্য খাত। এমনকি পশ্চিমতীরের পানির উৎসের প্রবাহ খাতও ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে ইসরাইলি বসতি, শিল্প ও কৃষির দিকে। ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনিরা জলপাই বাগান করাসহ রোপণ করেছিলেন ২৫ লাখ গাছ। কিন্তু দেশটির কৃষকরা সেই ভূমিও হারিয়েছেন, পাননি গাছগুলোর অধিকার। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি ছয় লাখ ২০ হাজার শরণার্থীর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৪ হাজার দুনাম, আর সেখানে ৪০ লাখ ফিলিস্তিনি পেয়েছেন এক লাখ দুনাম জমি। এক দুনাম সমান প্রায় এক হাজার বর্গমিটার (দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে, তানজীর মেহেদী)।
বসতি নির্মাণ এখন পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল মিসরের সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুসালেম, পশ্চিমতীর আর গাজা দখল করে নেয়। জাতিসঙ্ঘ বিভিন্ন প্রস্তাবে সেসব জমি ফেরত দিতে ও দখলীকৃত জমিতে ইহুদি বসতি স্থাপন অবৈধ ঘোষণা করে কয়েকটি প্রস্তাব পাস করে, কিন্তু ইহুদিরা কোনো প্রস্তাব গ্রাহ্য করেনি। উল্টো ক্রমে ইসরাইল আরো বেশি আরব ভূমি দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। যে মুহূর্তে মাহমুদ আব্বাস স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ‘স্বপ্নকে’ পূর্ণতা দেয়ার দাবি জাতিসঙ্ঘে উপস্থাপন করছেন; সে সময় পূর্ব জেরুসালেমে এক হাজার ১০০ নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়। পাঁচ লক্ষাধিক ইসরাইলি এখন দখলীকৃত ফিলিস্তিনি ভূমির অধিবাসী। ক্রমে ইহুদিরা যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নিচ্ছে; ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনে যথেষ্ট পরিমাণ জমি অবশিষ্ট থাকবে কি না সন্দেহ। পূর্ব জেরুসালেম ও পশ্চিমতীরে ইসরাইলি বসতি স্থাপন চলতে থাকবে, আর আলোচনার প্রস্তুতি চলবে- এমনটি হতে পারে না। বর্তমানে পশ্চিমতীর, গাজা, লেবানন, সিরিয়া আর জর্দানের শরণার্থী শিবিরগুলোয় ৭০ লাখ ফিলিস্তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী শক্তিরূপে দাঁড় করাতে আমেরিকা বার্ষিক তিন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে। শক্তির ভারসাম্য না থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নির্বীজ ও স্থাণু। জনমতের তোয়াক্কা না করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে স্বৈরাচারী চক্র ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রেখেছে বংশপরম্পরায়। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের ২২টি দেশ নিয়ে গঠিত আরব লিগের কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। আসলে কিছু করার শক্তিও নেই, মুরোদও নেই। অথচ ফিলিস্তিন আরব লিগের সদস্য।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ ছাড়া গোটা পৃথিবীর নীরব ভূমিকা কেবল দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। মুসলমানরা আজ অভিভাবকহীন। অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী বিশেষত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইহুদি জাতির দেড় হাজার মানুষ যদি মুসলমানরা মেরে ফেলত তাহলে এতক্ষণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠত। মুসলমানের শত্রু মুসলমান। জাতিসঙ্ঘ ও ২০০ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্বকারী ওআইসি কাগুজে বাঘ। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত মিসরের জনগণের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ইখওয়ানের সংগ্রামী কর্মীদের ওপর আমাদের প্রবল আস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সরকারপ্রধান নিজেদের গদি রক্ষার স্বার্থে ইহুদি সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এবং নেবেন না। রাজা-বাদশাহদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মুসলমানদের ঈমানি চেতনা ও জিহাদি জজবার কিন্তু কমতি নেই। ফিলিস্তিনি মজলুম ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা ইহুদি যুদ্ধোন্মাদ হায়েনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে থাকা শাসকদের ঈমানি দুর্বলতা লড়াইয়ের পথে বড় বাধা। ইসরাইলের বর্বর তাণ্ডবনৃত্য থামাতে হলে আরব জনগণকে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সত্যিকারের জনগণের সরকার।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে এটি প্রতিভাত হয়, নিকট ভবিষ্যতে সিরিয়া ও লেবাননে ইসরাইলিরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নতুন ভূখণ্ড দখল করে নেবে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ক্রমবর্ধমান ইহুদিদের বসতি স্থাপনে তাদের জায়গা প্রয়োজন। সিরিয়া ও লেবানন আক্রান্ত হলে বর্তমান মিত্র চীন ও রাশিয়া তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। ইরাক ও আফগানিস্তান রক্ষায় তাদের কোনো মিত্র এগিয়ে আসেনি। মক্কা-মদিনাসহ মধ্যপ্রাচ্যের এক বিরাট ভূখণ্ড নিয়ে স্বপ্নের এক ইসরাইল গড়ার যে পরিকল্পনা জায়নবাদী পণ্ডিতদের আছে, তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে চায় ইহুদিরা।
আজ যদি শক্তিশালী খিলাফত ব্যবস্থা চালু থাকত, তাহলে খলিফাতুল মুসলিমিনের ডাকে সারা বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধারা ফিলিস্তিনের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের রক্ষায় এগিয়ে আসত। দূতিয়ালি, আলোচনা, যুদ্ধবিরতি, সংলাপ- এসব স্থায়ী সমাধান নয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়ায় যেসব মুক্তিসেনা বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে নবীন প্রভাতের সূচনা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাদের এগিয়ে আসতে হবে আগ্রাসন প্রতিরোধে। ফিলিস্তিনের শাহাদতপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের প্রতিটি রক্তের ফোঁটা বুলেট হয়ে ইহুদি ও তাদের দোসরদের আঘাত হানবে, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার। হামাস ও ফাতাহের বিভাজনরেখা মুছে ফেলতে হবে। পৃথিবী নতুন সালাহউদ্দিনের অপেক্ষায় আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বজ্রনিনাদ শোনার জন্য দুনিয়ার মজলুম মানুষ প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। আমাদের এ কথা মনে রাখা দরকার, নিপীড়িত জনগণের কাছে অস্ত্র হচ্ছে মুক্তির ভাষা। কোনো শক্তিমান চিরঞ্জীব নয়। সময়ের ব্যবধানে বিশ্বজয়ী রোমান সাম্রাজ্য খান খান হয়ে গেছে জার্মান জাতির আক্রমণে। আর পারস্যের আধিপত্য ছারখার করে দিয়েছে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলের তাণ্ডব ও মানবতাবিধ্বংসী রণ উন্মাদনা শেষ হয়ে যাবে প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রলয় অভিঘাতে। পৃথিবীতে কোনো রক্ত বৃথা যায় না। গাজার নিরীহ শিশু ও মহিলাদের আত্মদানও বৃথা যাবে না। মৃত্যু ও ধ্বংসের মধ্যেও হামাস যোদ্ধারা নতুন স্বপ্ন দেখছে। নতুন ইতিহাস গড়ায় মুমিনদের এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানবতাবাদী মানুষের সমর্থন রয়েছে ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষদের প্রতি। এ মুহূর্তে এটিই বাস্তবতা। আল্লাহ তুমি ফিলিস্তিনের জনগণকে সাহায্য করো। মুজাহিদিনদের কোরবানির বদৌলতে গাজায় বদরের মতো পরিস্থিতি-পরিবেশ আবার তৈরি হোক- এটি মুসলমানদের কামনা ও মুনাজাত।
লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (নয়াদিগন্ত থেকে নেওয়া)
আপনার মতামত লিখুন :