সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক ধারাগুলো সংশোধন করে চুক্তি পূনঃমূল্যায়নের দাবি নাগরিক পরিষদের

প্রতিনিধিঃ- পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩ বছর বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক ধারাগুলো সংশোধন করে চুক্তি পূনঃমূল্যায়নের দাবিতে সাংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখা। ২রা ডিসেম্বর বুধবার সকাল ১১টায় খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এ সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি মোঃ আব্দুল মজিদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ সভাপতি অধ্যক্ষ আবু তাহের। এসময় সংগঠনটির জেলা কমিটির সহ-সভাপতি এসএম মাসুম রানা, সাধারণ সম্পাদক মোঃ লোকমান হোসেন, জেলা কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উল্লাহ প্রমূূখ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন শান্তি বাহিনী রক্তের হোলি খেলায় মেতে ছিল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার অবসান ঘটে। ২রা ডিসেম্বর ২০২০ খ্রি: বুধবার সেই শান্তি চুক্তির ২৩ বছর পূর্তি হয়েছে। শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তি বাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা সন্তু লারমা তার বিপুলসংখ্যক সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। সরকার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ প্রদান করে। আশা ছিল পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে, তবে চারটি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে চলছে অস্ত্রের মহড়া, মহা উৎসবে চলছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড । শান্তি চুক্তির পর কেটে গেছে ২৩টি বছর। একের পর এক চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে পাহাড় জুড়ে। সরকারের দাবি চুক্তির অধিকাংশ ধারাই এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট কিছু ধারা বাস্তবায়নাধীন। তবে জেএসএসের এ শান্তি চুক্তি সম্পাদনের বিরোধিতায় রয়েছে সংগঠনটির বিবদমান একটি গ্রুপ। পরবর্তীতে যারা ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) নামে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে। শান্তি চুক্তির পর জেএসএসের সামরিক উইং শান্তি বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে। এ উইংয়ের সদস্যদের অনেককে সরকার নানাভাবে পুনর্বাসিত করেছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য গত ২১ বছরে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে নানা স্থাপনা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা অভাবনীয় হলেও গত দুই দশকে চারটি গ্রুপের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। পাহাড়ের বাসিন্দারা যদি একটা কলার ছড়া বাজারে বিক্রি করতে যায়, তাহলে চাঁদা দিতে হয়। মূলত এই চার সশস্ত্র গ্রুপকে নির্ধারিত হারে চাঁদা দেওয়া ছাড়া কোনো পাহাড়ি ও বাঙালির রক্ষা নেই। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা এ চারটি গ্রুপ পার্বত্য অঞ্চলে যার যার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলছে। এ চারটি গ্রুপের চাঁদা ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
বক্তারা বলেন, একদিকে চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলে একে একে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসিত) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্বত্য অঞ্চলে দাঁবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। তাদের কাছে পাহাড়ি বাঙালিরা জিম্মি। অশান্তি সৃষ্টির মূলে রয়েছে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ। এ চারটি গ্রুপের মধ্যে যতদিন সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান না হবে ততদিন পাহাড়ে শান্তি আসবে না। তাই তাদের নির্মূল করা জরুরী । অন্যদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির খ খন্ডের ৩৪ ধারা অনুযায়ী ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার ৩০টি বিভাগ, রাঙামাটি জেলার ৩০টি বিভাগ এবং বান্দরবান জেলার ২৮টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘ খন্ডের ১ ধারা অনুযায়ী ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারকে ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ২০ বছর পূর্বে যারা চাকরি ত্যাগ করেছিল তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। প্রত্যাবাসিত শরণার্থীদের ভূমি সমস্যার সমাধান কল্পে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতারা বলেন, শান্তিচুক্তি করার সময় বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে তাদের ‘অ-উপজাতি’ আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয় চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১ নং ধারায় ‘উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধায় পার্বত্য উপজাতিদের নানা অগ্রাধিকার শর্তযুক্ত করে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।