প্রকাশ্যে জামায়াতের দ্বন্ধ !

সবুজ পাতা ডেস্ক : মানবতাবিরোধী যুদ্ধঅপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ শুরু হয়। মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা গ্রেপ্তার হলে নেতৃত্ব সংকটসহ নানা কারণে সংগঠনটির মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়।
তরুণ নেতারা দলীয় ফোরামে ওই সময়ে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়াসহ সংস্কার প্রস্তাব দেয়।
ফলে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের তরুণ নেতৃত্বের একটি অংশ নতুন করে ওই প্রস্তাব ও আলোচনা সামনে আনে। ২০০১ সালে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও ২০১০ সালে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কারাগার থেকে চিঠির মাধ্যমে প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে বলে জানা যায়।
মকবুল আহমাদ-ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠনেও তার প্রভাব দেখা যায়। দ্বন্দ্বের কারণে ব্যারিস্টার রাজ্জাককে বর্তমান কমিটিতে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদ ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এই নিয়ে তার অনুসারী আইনজীবীরা ওই সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। জামায়াতের এক নেতা জানান, যদিও ওই সময়ে দলের গঠনতন্ত্র না মেনে আমির মকবুল আহমাদ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আমিরকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নেতাদের ধারণা, জামায়াতে যা হচ্ছে সব কিছুর জন্য দায়ী বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানই। এসব দ্বন্দ্বের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলেও তা দৃশ্যমান না হওয়ায় বরাবরই দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ‘জামায়াত ঐক্যবদ্ধ’। জামায়াত সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ছাইচাপা দিয়ে রাখতে পারলেও দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্যে এসেছে।
১৫ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার দলটির অন্যতম সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সংগঠন থেকে পদত্যাগ করলে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শুধু রাজ্জাকই নন, অনেক নেতাই এই দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে নিষ্ক্রিয় অথবা দল ছেড়ে দেবেন বলে তথ্য রয়েছে।
তাদের ভাষ্য, দলের বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে চলেন। বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতে না পারলেও শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরোয়াভাবে এসব জামায়াত নেতা তাদের উদ্দেশ্য-চিন্তা বাস্তবায়নে কাজও করছেন। এ অবস্থাায় গুঞ্জন উঠেছে পদত্যাগী রাজ্জাক নিজ অনুসারীদের নিয়ে নতুন দল গড়বেন কিনা।
গণমাধ্যমকে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেছেন, নতুন কোনো দল তিনি গঠন করছেন না। এ ঘটনার মধ্যে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগের পর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ দীর্ঘদিন এই সংগঠনে আমরা কাজ করেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র পর্যায়ের দায়িত্বশীল ছিলেন। তার অতীতের সব অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থা থাকুন। আমরা আশা করি তার সঙ্গে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রথমে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের বিজয়ের পর তৎকালীন দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক একাত্তরের মূল্যায়ন ও ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দেন। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে যারা ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাদের অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য জামায়াতের ভুল স্বীকার করা উচিত। এ অংশটি মনে করে, একাত্তরে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকার পরও তাদের ভুলের দায় আর বহন না করাই উত্তম। তারা মনে করেন, ২০০১ সালে দেওয়া ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের প্রস্তাব মানলে জামায়াতকে এত বড় রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখে পড়তে হতো না। যদিও আবদুর রাজ্জাকই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী ছিলেন।
যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দ- কার্যকর হওয়ার ৫ দিনের মাথায় তিনি দেশ ছাড়েন। এ নিয়ে তখন নানা অভিযোগ উঠেছিল খোদ দলটির ভেতর থেকে। রাজ্জাক যুক্তরাজ্যেরও নাগরিক। বর্তমানে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। প্রায় ৯ বছর আগে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ- কার্যকর) ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন পর কারাগার থেকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রস্তাব করেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দায়িত্বশীলদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী নামও বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারসহ তখনকার সিনিয়র নেতাদের বাধার কারণে সেটা আর এগোয়নি।
সম্প্রতি দল বিলুপ্ত করার আলোচনায় এলে মতিউর রহমান নিজামীর ছোট ছেলে নাদিমুর রহমান তালহা গত ১৭ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, ‘নিছক শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এবং শত্রুকে খুশি করার জন্য তার নিজের রক্ত দিয়ে গড়া ঘরটি ভেঙে দেওয়া কোনো বিবেকবান ব্যক্তির কাজ হতে পারে না।’ নতুন করে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিাতি মূল্যায়ন করার জন্য সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয় দলের তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে সভায় একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দলের সর্বো”চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি।
জামায়াতে ইসলামীকে বিলুপ্ত করতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বলেছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তার প্রস্তাব বিবেচনায় না নেওয়ার হতাশা থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের কাছে দেওয়া পদত্যাগপত্রে মকবুল আহমাদকে ‘পরম শ্রদ্ধেয় মকবুল ভাই’ বলে সম্বোধন করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। যুক্তরাজ্য থেকেই তিনি পদত্যাগপত্রটি পাঠান। পদত্যাগপত্রের এক জায়গায় তিনি লিখেন, ‘ডিসেম্বরের নির্বাচনের (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পদত্যাগের পেছনে আবদুর রাজ্জাক দুটি কারণ উল্লেখ করেন। এতে বলা হয়, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে ও অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে দলটি নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা দলীয় প্রতীক হারিয়েছে। জামায়াত নেতারা জানান, তাদের কাজ করতে হচ্ছে গোপন দলের মতো। রাজ্জাক পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘অতীতে আমি অনেকবার পদত্যাগের কথা ভেবেছি।
কিন্তু এই ভেবে নিজেকে বিরত রেখেছি যে, যদি আমি অভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে পারি এবং ’৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চায়, তা হলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে।’ পদত্যাগপত্রের শেষ দিকে রাজ্জাক জামায়াতের নেতাদের প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘গত ১০ বছরে জামায়াত নেতারা অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন। তা এখনো অব্যাহত। এটি প্রশংসনীয় যে এই কঠিন ও বৈরী সময়েও ব্যাপক কষ্ট এবং অসীম ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে জামায়াত নেতারা দলের ঐক্য বজায় রেখেছেন। দলের প্রতি তাদের নিষ্ঠা এ একাগ্রতা অনস্বীকার্য।’ রাজ্জাক উল্লেখ করেন, এখন থেকে তিনি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চান। ১৯৮৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্রে আরও বলেন, জামায়াত ৬০-এর দশকে সব সংগ্রামে যেমন অংশ নিয়েছে- তেমনি ৮০-র দশকে আট দল, সাত দল ও পাঁচ দলের সঙ্গে যুগপৎভাবে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে।
দলটির অসামান্য অবদান ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে স্বীকৃতি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সব সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। তিনি জানান, ২০০১ সালে জামায়াতের সে সময়ের আমির এবং সেক্রেটারি জেনারেল মন্ত্রী হওয়ার পর বিজয় দিবসের আগেই ১৯৭১ নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন একটি কমিটি এবং বক্তব্যের খসড়াও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকেও তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থাার সময়েও তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
পরে ২০১১ সালে মজলিসে শূরার সবশেষ প্রকাশ্য অধিবেশনেও তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন, কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের অবহেলায় তার প্রস্তাব ভেস্তে যায়। এর পর ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বর্তমান আমির মকবুল আহমাদকেও চিঠি পাঠিয়ে ১৯৭১ প্রসঙ্গে বক্তব্য দেওয়ার প্রস্তাব দেন। মকবুল আহমাদ আমির হওয়ার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের মতামত চাইলে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া সংক্রান্ত একটি খসড়া বক্তব্য প্রেরন করেন।